উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৫/০১/২০২৫ ৫:৩০ এএম

আবু তাহের ও শফিকুল ইসলাম::
বৈশ্বিক অভিবাসীর উৎস তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। কর্মসংস্থানের জন্য প্রতি বছর বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন গড়ে অন্তত ১০ লাখ মানুষ। উন্নততর কর্মসংস্থান ও জীবিকার খোঁজে বিদেশ পাড়ি দিতে আগ্রহীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

বৈশ্বিক অভিবাসীর উৎস তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। কর্মসংস্থানের জন্য প্রতি বছর বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন গড়ে অন্তত ১০ লাখ মানুষ। উন্নততর কর্মসংস্থান ও জীবিকার খোঁজে বিদেশ পাড়ি দিতে আগ্রহীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ সুযোগের ফায়দা নিতে গড়ে উঠেছে সক্রিয় সিন্ডিকেট। দালাল চক্রকে কাজে লাগিয়ে সংঘটিত হচ্ছে অবৈধ পথে কর্মী পাঠানো, মানব পাচারের মতো অপরাধ। অনেক ক্ষেত্রে এসব অপরাধ ঘটছে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। পাচার হওয়া কর্মীরা বিদেশে গিয়ে শ্রমশোষণ, নির্যাতন এমনকি অপহরণ ও হত্যারও শিকার হচ্ছেন। এতে বিপত্তিতে পড়ছে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রফতানি খাত।

মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসন রোধে প্রায়ই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছে জনশক্তি আমদানিকারক দেশগুলো। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে ওমান, বাহরাইন, ইরাক, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, মিসর, রোমানিয়া, ব্রুনাই ও মালদ্বীপে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শ্রমবাজার আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ না হলেও গত বছর জুলাই থেকেই ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দিয়েছে দেশটি। একই সময়ে মালদ্বীপের পক্ষ থেকেও বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়াও নিয়মিত বিরতিতে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য ভিসা গ্রহণের পথ রুদ্ধ করে দেয়। মানব পাচারের অভিযোগে সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবের বাংলাদেশীদের জন্য ওমরাহ ভিসা দেয়া বন্ধ করারও নজির রয়েছে। ২০১৭ সালে একইভাবে ভিসা বন্ধের ঘোষণা দেয় বাহরাইন। বারবার অবৈধ অভিবাসন ও মানব পাচারের অভিযোগে এসব দেশে নিয়মিতভাবেই বৈধ ভিসা নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদেরও হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে বিমানবন্দরে কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহার ও হেনস্তার শিকার হওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে মানব পাচার, অবৈধভাবে সাগর পাড়ি এবং অভিবাসন গমনেচ্ছুদের জিম্মি করে অর্থ আদায়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের বাজারেও এখন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশীরা প্রতি বছরই শরণার্থী হিসেবে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ইউরোপে বাংলাদেশীদের শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় প্রার্থনার সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোয় আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন ৪০ হাজার ৩৩২ জন। তাদের মধ্যে আবেদন মঞ্জুর হয়েছে দুই হাজার জনের। মোট আশ্রয়প্রার্থীর ৫৮ শতাংশ আবেদন করেছেন ইতালিতে। আর ফ্রান্সে আবেদন করেছেন ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে ইতালিতে শরণার্থী হিসেবে ঢোকা অভিবাসীদের উৎস দেশের তালিকায় এরই মধ্যে শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। গত বছর দেশটিতে আর কোনো বাংলাদেশীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দেয় ইতালি। বিপুলসংখ্যক জাল নথির কারণে ইতালি সরকার গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি নাগরিকদের অনুকূলে সব ওয়ার্ক পারমিটের বৈধতা স্থগিত করেছে, যা যথাযথ যাচাইকরণ না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। সার্বিয়ার শ্রম ভিসা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসন খাত সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে আলাদাভাবে ব্যাপক মনোযোগের দাবি রাখে। কারণ দেশে অর্থনীতির অন্যতম বড় চালিকাশক্তি এখন রেমিট্যান্স। বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এ খাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সরকারের উচিত টেকসই উন্নয়ন ও স্থিতিশীল শ্রমবাজার গঠনে প্রয়োজনে কমিশন গঠন করে বড় সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া।

এ বিষয়ে কথা বলতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। পরে তাকে সেলফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।

বহির্বিশ্বে অভিবাসন খাতে ভাবমূর্তি ফেরাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি জোরালো কোনো উদ্যোগ। বরং আওয়ামী লীগের আমলে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে খোদ সরকারি দলের নেতাকর্মী, এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ বিদেশে গ্রেফতার হয়ে জেলও খেটেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আমলে বহির্বিশ্বে ক্ষুণ্ন হওয়া এ ভাবমূর্তি ফেরাতে জোরালো পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল। কিন্তু এখনো এসব চক্রের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি অভিবাসন খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ছয় মাসে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি বা সংস্কার পদক্ষেপও দেখা যায়নি। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী অভিবাসনের প্রত্যাশায় পাড়ি জমাচ্ছেন ইউরোপের উদ্দেশে। দালালের খপ্পরে পড়ে তাদের অনেকেই অবৈধভাবে ছোট ছোট নৌকায় করে উত্তর আফ্রিকা থেকে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ-উত্তাল ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইউরোপের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন। বিপৎসংকুল এ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণহানি হচ্ছে অনেকেরই। আবার নৌকায় ওঠার আগেই লিবীয় পাচারকারী চক্রের হাতে অপহৃত হয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অনেকে। প্রাণহানিও ঘটছে। বর্তমানে সাগরপথে অবৈধভাবে ইউরোপগামী অভিবাসীর উৎস দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।

দেশ থেকে কর্মস্থানে সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য। বাংলাদেশ থেকে ৮০ শতাংশের বেশি কর্মী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ওমান, বাহরাইনে প্রবেশ করছে। শ্রমবাজারে বিপুলসংখ্যক কর্মী প্রবেশকে ঘিরে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিপুল পরিমাণ রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের নেতারা যুক্ত হয়ে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে, মূলত শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর নামে এদের বড় একটি অংশ মানব পাচার, সিন্ডিকেট বাণিজ্যসহ বিপুল পরিমাণ মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছে। যাদের লক্ষ্যই ছিল সবসময় অর্থ আয় করা। অনেক ক্ষেত্রেই মানব পাচারের সঙ্গে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর যোগসাজশ পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া শ্রমশক্তির অন্যতম বড় বাজার মালয়েশিয়া। নির্ধারিত ফির অনেক বেশি অর্থ পরিশোধ করেও সিন্ডিকেটের কারণে গত বছর মধ্যে দেশটিতে যেতে পারেনি প্রায় ১৮ হাজার কর্মী। এখন পর্যন্ত বিষয়টির কোনো সুরাহা না হওয়ায় গত বুধবার তারা রাজধানীর কারওয়ান বাজার অবরোধ করে আন্দোলন করতে থাকেন। পরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত কর্মসূচি স্থগিতের ঘোষণা দেন তারা।

অভিযোগ আছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারকে ঘিরে ওঠা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের প্রভাবশালী চার সাবেক এমপি ও মন্ত্রী। তারা হলেন নিজাম উদ্দিন হাজারী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। জনশক্তি রফতানিতে সিন্ডিকেট গড়ে দেড় বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের পাশাপাশি ফেনীর সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর (নাসিম) বিরুদ্ধেও রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স ব্যবহার করে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটসহ নানা কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

দুদক এখন আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামালের বিরুদ্ধেও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত চালাচ্ছে। কাশমেরী কামাল অর্বিটালস এন্টারপ্রাইজ ও নাফিসা কামাল অর্বিটালস ইন্টারন্যাশনাল নামে দুটো এজেন্সির লাইসেন্স নিয়েছিলেন। এর মধ্যে কাশমেরী কামালের অর্বিটালস এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে আট হাজার কর্মী বিদেশে গেছে। এসব শ্রমিকের বড় একটি অংশ সেখানে গিয়ে কাজ না পাওয়া ও পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে দুর্বিষহ ও মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করার অভিযোগ তুলেছেন। বর্তমানে প্রতারণার অভিযোগে এ শ্রমিকদের করা মামলা মালয়েশিয়ার আদালতে চলমান রয়েছে।

বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বৃহৎ সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে ও বাজার নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনীতির মাঠ থেকে সরাসরি শ্রমবাজারে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন ছাত্রলীগ, যুবলীগের একাধিক নেতাকর্মী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রমবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেষ চার বছরে (২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত) ১ হাজার ৩১টি রিক্রুটিং লাইসেন্স অনুমোদন করে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। যেখানে এর আগের ৩০ বছরে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল ৯৯১টির। অভিযোগ রয়েছে, এসব রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নিয়ে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব খাটিয়ে বিদেশে কর্মী পাঠানোর নামে বিপুলসংখ্যক কর্মীকে মানব পাচার করা হয়েছে। এসব কর্মী শ্রমবাজারে প্রবেশ করে কোনো কাজ না পেয়ে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ অর্থ খুইয়েছে, অন্যদিকে সেখানে যাওয়ার পর নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি প্রাণহানি ঘটেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সরকারের মানব পাচারসংক্রান্ত পরিসংখ্যানের অসংগতি বাংলাদেশে মানব পাচার রোধের বড় অন্তরায়। সরকারের মানব পাচার রোধে গৃহীত কার্যক্রম ন্যূনতম মান অর্জন করতে না পারায় মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈশ্বিক মানব পাচার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো টিয়ার ২-এ।

বিশ্বে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন গমনেচ্ছুদের যাওয়া শুরু হয় সত্তরের দশকে। বিএমইটির তথ্য বলছে, ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে অন্তত ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ। আর ২০২৪ সালে গেছে আরো নয় লাখের বেশি কর্মী। সব হিসাব মিলিয়ে পাঁচ দশকের বেশি সময়ে শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে অন্তত ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। যার বেশির ভাগই কর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান ও লিবিয়ায়। এছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশে।

গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ে বাংলাদেশ থেকে শ্রমবাজারে কর্মী প্রবেশের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বাণিজ্য, শ্রমবাজারে প্রতারণা ও মানব পাচারের কারণে ভিসা বন্ধ করে দেয় বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে ২০২১ সালে দ্বিতীয় এমওইউর (মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার খুলেছিল একটি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশটির কর্মী গেলেও ২০২৪ সালের মে মাসে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। বেস্টিনেট এবং এফডব্লিউসিএমএস স্বত্বাধিকারী মালয়েশিয়ান নাগরিক দাতো আমিন এবং বাংলাদেশী সহযোগী রুহুল আমিন যৌথভাবে এ সিন্ডিকেট তৈরি করেছিল। এ সিন্ডিকেট মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের মাধ্যমে ২ বিলিয়ন অর্থ অভিবাসী কর্মীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়। বর্তমানে এ সিন্ডিকেটে যুক্ত থাকার অভিযোগে বর্তমান সরকার বাংলাদেশের সাবেক চার এমপির বিরূদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এছাড়া মালয়েশিয়া সরকারের কাছে এ সিন্ডিকেটের দুই সদস্যকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সেদেশের সরকারের কাছে চিঠিও দিয়েছে।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটের বড় অনিয়ম হলো উচ্চ ব্যয়ে দেশটিতে কর্মী পাঠানো। দুদকের এক সারসংক্ষেপে দেখা গেছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশী কর্মী খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দেড় বছরে সাড়ে চার লাখের মতো কর্মী পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে। সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেয়া হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চক্র ফি নেয়া হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।

মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশে দ্বিতীয় শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটিতে কাজের সন্ধানে বিপুলসংখ্যক কর্মী প্রবেশ করে অবৈধ হয়ে গেছেন। গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটি অনিয়মিত বিদেশী কর্মীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। এরই মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি বাংলাদেশী সাধারণ ক্ষমার সুযোগ গ্রহণ করেছেন।

অবৈধভাবে ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রবেশ করতে মানব পাচারের বিভিন্ন রুট তৈরি হয়েছে বিগত কয়েক বছর ধরে। বিশেষ করে কক্সবাজার, ময়মনসিংহ ও যশোর মানব পাচারের হটস্পট হয়ে উঠেছে বলে গত বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে। মানব পাচার প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে সে সময় দুই বছরের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে বিগত সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাবলিক সিকিউরিটি ডিভিশনের ন্যাশনাল প্ল্যান অব অ্যাকশন প্রিভেনশন অ্যান্ড সাপ্রেশন অব হিউম্যান ট্রাফিকিং (আপডেটেড ২০২৩-২৫) প্রতিবেদনে কক্সবাজার, ময়মনসিংহ এবং যশোর জেলা মানব পাচারের হটস্পট বলে উল্লেখ করা হয়।

অভিবাসীদের নানা সমস্যা, সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘টেকসই অভিবাসন নিয়ে সরকারকে আরো জোরালোভাবে কাজ করা উচিত। বিশেষ করে বাংলাদেশে লেবার ট্রাফিকিং একটি বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ প্রয়োজন। বহুপক্ষীয় ফোরামগুলোতে পাচারের বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হতে হবে।’

বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের গতি-প্রকৃতি, অর্জন ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রামরু। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের আদ্যোপান্তসহ নানা বিষয় উপস্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সেই সঙ্গে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিছু পরামর্শও দিয়েছে। সেখানে অভিবাসন নিয়ে সরকারের কমিশন গঠনে সুশীল সমাজের মতামত তুলে ধরা হয়। এছাড়া শ্রমবাজারে অনিয়ম, দুর্নীতি, অভিবাসনে ব্যয় সংকোচন এবং অভিবাসীদের জন্য বাজেটে বরাদ্দের পরামর্শও দেয়া হয়।

বিদেশে অভিবাসনের নামে মানব পাচারকারীদের বড় একটি অংশ সক্রিয় বিগত কয়েক বছর ধরে। এ চক্র জনপ্রতি ২০-২৫ লাখ টাকা নিয়ে এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে অবৈধভাবে আমেরিকা ও ইউরোপে পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এ চক্র এতটাই সক্রিয় যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এজেন্ট নিয়োগ করে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে বিদেশ নিয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা কিংবা ইউরোপ অভিবাসন প্রত্যাশীদের কাছে ‘টারজান ভিসা’র প্রলোভন দেখিয়ে ইউরোপে নিয়ে যাচ্ছে। এ চক্র ফ্রি ভিসা নিয়ে শুরুতেই দুবাই বা দোহায় ট্রানজিট দিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের শুরুতেই নিয়ে যায় লিবিয়ায়। কেউ কেউ কাতার হয়ে দালালের মাধ্যমে তুরস্কে যায়। সম্প্রতি কোনো কোনো চক্র বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পৌঁছতে ভিন্ন রুট ব্যবহার করছে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে মানব পাচারকারীরা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কলকাতা, মুম্বাই, দুবাই, মিসর, বেনগাজি হয়ে ত্রিপোলিতে নিয়ে যায় বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে। আবার সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় দক্ষিণ সুদানের মরুভূমি পাড়ি দিয়েও লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। সেখান থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় গাদাগাদি করে নিয়ে যাওয়া হয় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের পথে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অভিবাসন ও রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেট বহু আগ থেকেই গড়ে উঠেছে। এ সিন্ডিকেট এখনো নানাভাবে সক্রিয়। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনে দুটি দিক রয়েছে। একটি বৈধ ও অবৈধ। বৈধ কাগজপত্র নিয়ে যারা বিদেশ যাচ্ছে তাদের বিষয়ে কোনো অনিয়ম হলে সেটি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় দেখভাল করে। তবে অবৈধভাবে যারা বিদেশ যাচ্ছে, তাদের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। টেকসই অভিবাসনের ক্ষেত্রে এককভাবে একটি মন্ত্রণালয় কাজ করলে এ খাতে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা আসবে না। এখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে শ্রমবাজারে গতি বাড়াতে এ খাতকে ঢেলে সাজানোর দরকার রয়েছে।’

অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে মানব পাচার আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার মধ্যে সচেতনতাও কম। আইনের প্রয়োগ বাড়ানো দরকার। মামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে আসে কম। মানব পাচার একটি আন্তর্জাতিক চক্র। বাংলাদেশ একা কাজ করলে হবে না। যেসব রুট জানা যায়, সেসব দেশে বর্ডার ফোর্স, ইন্টেলিজেন্ট ও ইন্টারপোলের সমন্বয়ে কাজ করতে হবে। রুটগুলো চিহ্নিত করতে বিভিন্ন দূতাবাস, গবেষকের মাধ্যমে আরো তৎপরতা দরকার। যদি দৃষ্টান্তমূলকভাবে কয়েকটি ব্যবস্থা নেয়া যায় তাহলে অন্যরাও সচেতন হবে। জিরো টলারেন্স অবস্থান নিতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাও চাইলে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে পারে। তাদের অনেকেরই ঢাকায় অনলাইন কিংবা সাইনবোর্ড অথবা অন্য কোনো স্টাবলিশমেন্ট আছে। সাইবার সিকিউরিটি ও ইন্টেলিজেন্স বাহিনী তাদের শনাক্ত করতে পারবে।’ সুত্র, বণিক বার্তা

পাঠকের মতামত

সৌদি কোম্পানি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর পরিচালনায় আগ্রহী

সৌদি মালিকানাধীন বন্দর পরিচালনাকারী কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল বাংলাদেশের মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর পরিচালনার আগ্রহ ...

অনলাইন জুয়া / দেশে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যারা , হেডকোয়ার্টার রাশিয়া

মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বিশ্বনাথপুর-শিবপুর সড়কে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে একটি নির্মাণাধীন বাগানবাড়ি দেখালেন স্থানীয় আবুল হোসেন। ...

সীমান্তে সাউন্ড গ্রেনেড-টিয়ারশেল ব্যবহারের অনুমতি পেল বিজিবি

লালমনিরহাট সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কয়েকদিন ধরে চলা উত্তেজনার পর, বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিজিবি) সাউন্ড গ্রেনেড ...